সন্তান জন্মানো এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা। এটি শুধু একটি নতুন জীবনের শুরু নয়, বরং একজন নারীর জীবনের এক নতুন অধ্যায়। তবে সন্তান জন্মের পরপরই একজন মায়ের জীবনে যে বিশাল পরিবর্তন আসে, তা শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক—তিনদিক থেকেই। এই সময়টা একদিকে যেমন আনন্দের, অন্যদিকে তেমনই ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। তাই সন্তান জন্মের পর একজন মায়ের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা অভ্যাস অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি।
আজকের এই লেখায় আমরা জানবো, সন্তান জন্মের পর মাকে কোন ৭টি কাজ অবশ্যই করা উচিত, যা শুধু শিশুর যত্নেই নয়, বরং নিজের সুস্থতা, মানসিক ভারসাম্য এবং পরিবার পরিচালনায় সহায়ক হবে।
১. নিজের শারীরিক রিকভারির যত্ন নেওয়া
শিশু জন্মের পর শরীর পুরোপুরি দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক প্রসব হোক বা সিজারিয়ান, উভয় ক্ষেত্রেই শরীর নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে সময় নেয়। এসময় বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার এবং যথাযথ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
মায়ের করণীয়:
-
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া
-
প্রচুর পানি পান করা
-
আয়রন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া
-
নিয়মিত গাইনি ডাক্তার দেখানো
-
ওজন বা ব্যথা বাড়লে অবহেলা না করা
শরীর ঠিক না থাকলে মনও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই নিজের যত্ন কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
২. মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া
মায়ের করণীয়:
নিজের অনুভূতির কথা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করা
একা না থেকে বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখা
বই পড়া, হালকা গান শোনা, অথবা পছন্দের কিছু করা
প্রয়োজনে কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া
মনে রাখতে হবে, সুখী মা মানেই সুখী পরিবার।
৩. শিশুর খাওয়ানো ও ঘুমের রুটিন মেনে চলা
শিশুর জীবনের প্রথম কয়েক মাসে ঘন ঘন খাওয়াতে হয়। পাশাপাশি ঘুমের অভ্যাসও তৈরি করতে হয় ধাপে ধাপে। তাই মায়ের উচিত সঠিক সময় মতো দুধ খাওয়ানো, ডায়াপার বদলানো, এবং ঘুমের পরিবেশ তৈরি করা।
মায়ের করণীয়:
-
প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর সময় নোট রাখা
-
রাতের বেলায় ঘর অন্ধকার রাখা যাতে শিশুর ঘুম সহজ হয়
-
কোল বা দোলনায় না ঘুম পাড়িয়ে বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস করানো
-
মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যদের দিয়ে শিশুর দেখভাল করিয়ে নিজে বিশ্রাম নেওয়া
৪. পরিচ্ছন্নতা ও সংক্রমণ রোধে সতর্ক থাকা
নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই দুর্বল। তাই মা ও আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মায়ের করণীয়:
-
বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার আগে হাত ধোয়া
-
ব্যবহৃত কাপড়, তোয়ালে, বিছানা পরিষ্কার রাখা
-
ডায়াপার পাল্টানোর পর হাত জীবাণুমুক্ত করা
-
বাচ্চার নখ ছোট রাখা এবং মুখে হাত না দিতে শেখানো
শিশুর সুস্থতায় এসব ছোট কাজগুলো অনেক বড় প্রভাব ফেলে।
৫. স্তনদুগ্ধ (ব্রেস্টফিডিং) চালিয়ে যাওয়া ও সমস্যা হলে সহায়তা নেওয়া
মায়ের দুধই শিশুর জন্য আদর্শ খাবার। তবে অনেক সময় দুধ কম হওয়া, ব্যথা হওয়া, বা ব্রেস্ট ইনফেকশনের সমস্যা হয়।
মায়ের করণীয়:
-
নিয়মিত ব্রেস্টফিডিং চালিয়ে যাওয়া
-
ডাক্তারের পরামর্শে ব্রেস্ট পাম্প ব্যবহার করা
-
ব্রেস্টে ব্যথা বা ফোলা হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া
-
পুষ্টিকর খাবার খাওয়া যাতে দুধ উৎপাদন বাড়ে
মনে রাখবেন, স্তনদুগ্ধ শুধু শিশুকে পুষ্টিই দেয় না, বরং মা ও শিশুর মধ্যে বন্ধন গড়ে তোলে।
৬. পরিবারের দায়িত্ব বণ্টন করা ও সাহায্য নেওয়া
মা সব কাজ একা করতে গেলে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাই পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নেওয়া একদমই অপরাধ নয়, বরং প্রয়োজন।
মায়ের করণীয়:
-
স্বামীকে শিশুর দেখভাল ও অন্যান্য কাজে যুক্ত করা
-
ঘরের কাজ ভাগ করে দেওয়া
-
আত্মীয় বা কাছের বন্ধুদের সাহায্য নেওয়া
-
কোনো কারণে অসুবিধা হলে তা খোলাখুলি জানানো
সন্তান পালনের দায়িত্ব মা-বাবা উভয়ের, শুধুমাত্র মায়ের নয়।
৭. নিজের ভালো লাগার জিনিসগুলোতে সময় দেওয়া
সন্তান জন্মের পর অনেক মা ভুলে যান, তাঁরও একটা আলাদা পরিচয় আছে। নিজের পছন্দের কাজ করতে না পারলে একসময় হাঁপিয়ে উঠতে পারেন।
মায়ের করণীয়:
-
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট নিজের জন্য সময় বের করা
-
পছন্দের বই, সিনেমা বা গান উপভোগ করা
-
ধীরে ধীরে আগের শখ বা কাজের সাথে যুক্ত হওয়া
-
আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা – "আমি পারি" মনোভাব রাখা
সুখী ও আত্মবিশ্বাসী মা মানেই একটি সুখী সন্তানের ভবিষ্যৎ।
উপসংহার
মা হওয়া এক মহান দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের শরীর, মন, এবং ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে দূরত্ব তৈরি করে ফেলাটা ঠিক নয়। সন্তান জন্মের পর মায়েরা যেন সবসময় মনে রাখেন — নিজের যত্ন নেওয়া মানেই সন্তানের যত্ন নেওয়া।
এই সাতটি কাজ যদি প্রতিটি মা ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত করেন, তাহলে সন্তান লালন-পালন হবে আরও সুস্থ, সচেতন ও সুন্দরভাবে।





